DinajpurBD

স্মৃতির মিরগড়

Posted April 11th, 2012 by |

স্মৃতির মিরগড়

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

জেলা শহর পঞ্চগড়ের কেন্দ্রভাগে ঢোকার মুখেই মস্ত এক সড়কসেতু। করতোয়া নদীর ওপরে নির্মিত এই সেতু পার হয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, মিরগড় কোথায়, কোনদিকে? বেশ সহযোগিতাও পেলাম। শান্তস্নিগ্ধ প্রকৃতিকে সাথী করে বেশ সহজেই পৌঁছে গেলাম মিরগড় বাজারে। যেহেতু শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরেই এর অবস্থান এবং রাস্তা পাকা, তাই পঞ্চগড় শহর থেকে মিরগড় বাজারে পৌঁছানো খুবই সোজা ব্যাপার। তবে আসল ব্যাপারটা যত সহজ হবে বলে ভেবেছিলাম, মোটেই তত সহজ হলো না। মিরগড় বাজারে এসে বহুজনকে জিজ্ঞেস করলাম প্রাচীন দুর্গ মিরগড়ের কথা। কিন্তু তারা কেউই এর সন্ধান দিতে পারলেন না। যে দুর্গের নামে জায়গাটার নাম রাখা হয়েছে, তার কথাই লোকজন ভুলে গেছে। ব্যাপারটাকে অবিশ্বাস্য বলে মনে হলো। বিস্মৃতিপরায়ণ জাতি বলে কথা। আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বহুজনই আমার প্রশ্ন শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মনে হলো, এ জীবনে আমার আগে কেউই এ প্রশ্ন তাদের করেননি।

হাল তবুও ছাড়লাম না। কারণ যাদের জিজ্ঞেস করছিলাম তারা সবাই বয়সে নবীন। পুরনো ইতিহাসের খবর তাদের নাও জানা থাকতে পারে। তাই প্রবীণ কারো সঙ্গে কথা বলার আশায় এগিয়ে গেলাম আরো সামনে। কিন্তু একটা জায়গায় এসে পথ দুভাগে ভাগ হয়ে গেল। একটা পথ গেছে ডানে, অন্যটি বাঁয়ে। বড়ই দ্ব›েদ্ব পড়ে গেলাম। এমন সময় সামনের মসজিদে জামাতে নামাজ পড়া শেষে বেরিয়ে এলেন একদল মুসল্লি। তাদের প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করতেই পেছন থেকে এক উঠতি যুবক বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, চিনি চিনি।

বুঝলাম নবীনরাও ইতিহাসের খোঁজ রাখেন। তবে একই সঙ্গে তিনি হতাশাব্যঞ্জক একটা সংবাদও দিলেন। তা হলো মিরগড় দুর্গ এবং দুর্গপ্রাচীরটা কোথায় ছিল তা দেখা যাবে, কিন্তু পুরো প্রাচীরই এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বড় একটি চোট পেলাম মনে কিন্তু ঢাকা থেকে ৫শ কিলোমিটারের বেশি পথ পেরিয়ে এসে তো আর ফিরে যাওয়া চলবে না। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর আশায় পথে নামলাম।

সবাই জানেন, পঞ্চগড় জেলার বেশিরভাগ এলাকা ১৯৪৭ সালের আগে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ছিল এবং জলপাইগুড়ি জেলা সদর এই জেলার সীমান্ত থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সে যা-ই হোক, পুরনো কালের পাঁচটি দুর্গ বা গড়ের কারণে এই জেলার নাম হয়েছে পঞ্চগড়। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এই এলাকাটা আগে কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। রাজায় রাজায় যুদ্ধও হতো সেকালে এবং সেসব প্রয়োজনে দুর্গও নির্মাণ করা হতো। পঞ্চগড়ের পাঁচটি দুর্গের মধ্যে ভিতরগড়, বোদেশ্বরী গড়, দুটি পৃথক মিরগড় ও হোসেন গড়ের নাম জানা যায়। এর মধ্যে হোসেনগড় ও একটি মিরগড় অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। অন্য মিরগড়টি দেখার আশায় এখানে আসা।

মিরগড় দুর্গ এলাকার নিকটবর্তী হতেই কাকতালীয়ভাবে দেখা হয়ে গেল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। বড়ই সাহায্য করলেন তিনি এ যাত্রায়। তিনি পঞ্চগড় সদরের হাফিজাবাদ ইউনিয়নের পুকুরীডাঙা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। নাম মোহাম্মদ বদরুজ্জামান। তিনি জানালেন, পঞ্চগড় শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে। জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার, মন্ত্রী ও এমপি জমিরউদ্দিন সরকারের গ্রামের বাড়ির নিকটবর্তী ব্যারিস্টারের মোড়ের কাছাকাছি এলাকায় দেবনগরে একটি গড় ছিল, যা এখন পুরোপুরি বিলুপ্ত। এই দুর্গটির নাম ছিল হোসেনগড়। কামরূপ অভিযান চালানোর আগে বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) এটি নির্মাণ করেছিলেন। এর মাটির প্রাচীর ও পরিখা অনেক আগেই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। ‘বাঙলাদেশের প্রত্ন সম্পদ’ গ্রন্থের ২০০৭ সংস্করণের ৫৩ পৃষ্ঠায় আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া উল্লেখ করেছেন, দুর্গটি ছিল বর্গাকার এবং এর প্রতিবাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ১ দশমিক ৫ কিমি।

মোহাম্মদ বদরুজ্জামান আরো একটি বিলুপ্ত গড় বা দুর্গের সন্ধান দিলেন। এটি ছিল পঞ্চগড় শহরের রাজনগর এলাকায়। পুরনো গরুহাটা এবং রাজনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে ছিল এর অবস্থান। এখন এখানে গোরস্তান হয়েছে। যদিও সেই দুর্গ এবং দুর্গপ্রাচীর পুরোপুরি বিলুপ্ত, তবুও তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মাঝে মাঝে চ্যাপ্টা ইট দেখা যায়।

কথা বলতে বলতে এবং পুরনো তথ্য জোগাড় করতে করতে করতোয়া নদীর ধারে মিরগড় দুর্গ এলাকার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। জায়গাটা পঞ্চগড় শহরের প্রায় ৩ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে। করতোয়া নদী এখানটায় ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এগিয়ে গেলাম একেবারে সীমান্ত পিলারের পাশে। সীমান্ত নদীর ভেতর দিয়ে এগিয়েছে। তারপর খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে একের পর এক বসানো হয়েছে সীমান্ত পিলার। খুব কাছেই মাঠের ওপরে ভারতীয় সার্চ লাইট, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও কাঁটাতারের বেড়া। খুব কাছেই ভারতীয় এলাকার চা-বাগান। এপারে বাংলাদেশের আখক্ষেত। বাংলাদেশ ভ‚খণ্ডে  কোনো চা-বাগান নেই। নদীর মাঝখানে পোঁতা লম্বা সীমানা খুঁটির দিকে নির্দেশ করে বদরুজ্জামান জানালেন, এখানটাতেই ছিল মিরগড়ের প্রাচীন দুর্গ ও দুর্গপ্রাচীর। কাদামাটিতে গাঁথা চ্যাপ্টা ইটে তৈরি বিশাল এ দুর্গপ্রাচীর বহুদূর থেকে দেখা যেত। অনেকদিন মানুষ এর ক্ষতি করেছে। তবে আসল ক্ষতিটা হয়েছে নদীর কারণে। করতোয়ার ভাঙন বাংলাদেশের ভূমি ক্রমাগতভাবে গ্রাস করছে। ভাঙন এলাকায় বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে যাওয়া এবং  ওপারে চর পড়ে জমি বেড়ে যাওয়ায় মিরগড়ের দুর্গপ্রাচীর এখন নদীর গর্ভে রয়েছে। তবে দুর্গপ্রাচীরের অবস্থানটা কোথায় ছিল তা স্মৃতি থেকে কেউ কেউ বলতে পারেন।

সেই স্মৃতির ভিত্তিতে এগিয়ে গেলাম যেখানটায়, সেখান থেকে শুরু হয়েছিল ভাঙন। জায়গাটা দুটো সীমান্ত পিলারের প্রায় মাঝামাঝি অবস্থানে। দুপাশের প্রতি পিলার থেকে এটি প্রায় ৪৫ মিটার করে দূরত্বে। পশ্চিমের পিলার থেকে প্রায় ৪৫ মিটার পূর্বে, আর পূর্বের পিলার থেকে প্রায় ৪৫ মিটার পশ্চিমে। একেবারে জিরো পয়েন্ট ঘেঁষে। এখানে একটা কথা, এ জায়গাটায় অবাধ যাতায়াত ঝুঁকিপূর্ণ। স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে এ দুর্গ সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য পেলাম। সেই সূত্রেই ধ্বংস হওয়া দুর্গপ্রাচীর প্রায় ৪ মিটার উঁচু ছিল বলে জানলাম। তবে যেখানটায় দাঁড়ালাম, সেখানে এখনো উঁচু ঢিবি রয়েছে। অবশ্য তা সৃষ্টি হয়েছে মানুষের দ্বারা, মাটি খুঁড়ে পাথর উঠিয়ে নেয়ার ফলে। কিন্তু ওখানেও দূর অতীতে মিরগড় দুর্গপ্রাচীরের শেষ অংশ বিদ্যমান ছিল। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া প্রদত্ত ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের অবস্থার বর্ণনা অনুযায়ী দুর্গপ্রাচীরটি ছিল ৩ মিটার উঁচু এবং ওপরের দিকেও তিন মিটার চওড়া। প্রায় ২০০ মিটার দীর্ঘ মাটির প্রাচীর তিনি দেখেছিলেন এবং জনশ্রুতি অনুযায়ী দুর্গটি অনেক বড় ছিল (বাঙলাদেশের প্রতœসম্পদ, ২০০৭, পৃ. ৫৪)। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত জে. রেনেলের মানচিত্রে দুটি মিরগড়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকায় বোঝা যায়, একই নামের দুটি আলাদা দুর্গ ছিল, যার একটিও টিকে নেই।

তেমন কোনো প্রত্নবস্তু এখন আর এখানে মেলে না। কালেভদ্রে প্রাচীনকালের দুয়েকটা চ্যাপ্টা ইট স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ‘একদা আমিও ছিলাম’। ফেরার পথে সে কথাই মনে পড়তে লাগল।

https://www.shaptahik-2000.com/?p=947