বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুর অঞ্চলে নাগর, মহানন্দা, ঘোড়ামারা, করতোয়া (পঞ্চগড়), টাংগন, তালমা, ডাহুক, কুলিক ও পুনর্ভবা এই ৯টি সীমান্ত নদীসহ মোট ৩৬ নদী রয়েছে। অপর ২৭টি নদী হচ্ছে ছাতনাই, পাঁথরাজ, তীরনই (পঞ্চগড়), রামচণ্ডি, বোরকা, কুরুম, গোবরা, পেটকি, বেরং, ভেরসা, কচাওয়াই, ভুল্লী, ছোটটেপা, আমন-দামন, তীরনই (ঠাকুরগাঁও), লোনা, লাচ্ছি, শুক, সেনুয়া, নলশীসা, কালা, গভেশ্বরী, মাইলা, টেপা, কাকড়ী, আত্রাই আপার ও ইছামতি (দিনাজপুর)। এ সবক’টিই প্রধান নদী করতোয়া, মহানন্দা ও নাগরের শাখা কিংবা উপনদী। বিভিন্ন বিল অথবা বড় নদীগুলো থেকে এগুলোর উত্পত্তি;মিশেছেও বড় নদীতে।
পুনরভবা
সিমান্ত নদি পুনরভবা। মোট ১৬০ কিঃমিঃ লম্বা, ঠাকুরগাওয়ে নীচু জলাশয়ে এর উতপত্তি। আত্রাইর পশ্চীমে এটা মাত্র কয়েক কিলোমিটার উজানে। দক্ষিন দিনাজপুর, পশ্চিম বাংলা থেকে প্রবাহিত হয়ে এসে ঢেপার সংগে মিশেছে এখানে এবং শেষে পদ্মায়।
আত্রাই
প্রাচীন কালে এই নদীকে আত্রেই নামে, এবং এর কথা মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে। করতোয়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে। পশ্চিম বাংলায় উতপত্তি হয়ে বাংলাদেশের দিনাজপুরের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আবার ভারতে প্রবেশ করেছে। আবারও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে দুভাগে ভাগ হয়ে গাবুরা এবং কাঁকরা নাম নিয়ে দিনাজপুরের হয়ে বরেন্দ্রভুমি দিয়ে চলন বিলে প্রবেশ করেছে।
এই নদি প্রায় ২৪০ মাইল (৩৯০ কিঃমিঃ)।
মহানন্দা
মহানন্দার উতপত্তি হিমালয়ে। পঞ্চগড় জিলার তেতুলিয়ার কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, ৩ কিঃমিঃ প্রবাহিত হওয়ার পর আবার ভারতে প্রবেশ করে। পদ্মার সঙ্গে মেশে নওয়াবগঞ্জ জিলার গোদাগারির কাছে।
মহানন্দার ওপর বাংলাবান্দা সীমান্তে বিশাল বাঁধ নির্মাণ করে পানি সরিয়ে নিচ্ছে ভারত। ফলে দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের নদীগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
মোট দৈরঘ ৩৬০ কিঃ মিঃ (২২০ মাইল), এর মধ্যে ৩২৪ কিঃ মিঃ (২০১ মাইল) ভারতে এবং ৩৬ কিঃ মিঃ (২২ মাইল) বাংলাদেশে।
পঞ্চগড়ে প্রায় ২৩টি ছোট বড় নদী আছে, সেগুলো হচ্ছে – নাগর, সিঙ্গীয়া, বহু, নাগরা, রসিয়া (আটোয়ারী); মহানন্দা, ডাহুক, তীরনই, রনচন্ডী, বেরং, জোরাপানি, সাও (তেতুলিয়া); করতোয়া, চাওয়াই, তালমা, পাঙ্গা, কুরুম, পাম (পঞ্চগড় সদর); পাথরাজ, ঘোড়ামারা (বোদা), মরা তিস্তা, আত্রাই ভুলি (দেবিগঞ্জ)।
নাগর
অভিন্ন নদী নাগর (আপার) পঞ্চগড়ের অটোয়ারী উপজেলার বর্ষালুপাড়ায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অটোয়ারি, বালিয়াডাংগী, রানীসংকৈল উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পুনরায় ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর উপজেলা দিয়ে এটি পুনরায় ভারতে প্রবেশ করেছে। বর্ষালুপাড়ার উজানে সীমান্তের কাছে আরটেইকা নামক স্থানে একটি স্লুইসগেট দিয়ে নাগরের পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত। সুকনা মওসুমে নাগর নদী পানিশূন্য, বর্ষায় স্লুইসগেট খুলে দেয়ার ফলে ফসলের জমি,বাড়িঘর,হাটঘাট সবকিছু তলিয়ে যায়। নদীভাঙনে হারিয়ে যায় এপারের মূল্যবান জমি।
করতোয়া
করতোয়া আদিতে তিস্তার মুল নিস্কাশন উপনদী এবং ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদী মনে করা হতো।
ভাবা হয় নদীর নামটি এই ভাবে তৈরী হয়েছে –কর মানে ‘হাত’ এবং তোয়া মানে ‘পানি’। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনির বিন্যাসে শীবের পারবতীকে বিয়ের সময় তাঁর হাতে যে পানি ঢালা হয়েছিল সেই থেকেই এই নদির উতপত্তি।
চারভাগে বয়ে যাওয়া এই নদীর উত্তর অংশ যাকে বলা হয় দিনাজপুর করতোয়া, যা আত্রাইর মুল উতস এবং খানসামায় এসে নাম পরিবরত্তন করে হয় আত্রাই।দতিও অংশ রংপুর করতোয়া, জলপাইগুড়িতে উতপত্তি হয়ে গোবিন্দগঞ্জ উপজিলা পরযুন্ত দেওনাই-যমুনেশ্যরি নাম ধারন করে। তৃতীয় অংশ, যমুনেশ্যরী-করতোয়া দক্ষিন দক্ষীনপুরবে গবিন্দগঞ্জ উপজিলার দিকে প্রাবাহিত হয়ে এর মুল স্রোতধারা পুরবে দিক পরিবরতন করে কাটখালিতে মিশে বাঙ্গালী নদীতে পড়ে।
করতোয়া নদীটি ভারতের জলপাইগুঁড়ি থেকে তেতুলিয়া উপজেলার ময়নাগুঁড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, খানসামা, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলা হয়ে নদীটি আত্রাই নাম ধারণ করেছে। নদীটি শুকিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ অংশে এর তীরবর্তী ১২৬৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার মানুষ পড়েছে নানা দুর্ভোগে।
ষাটের দশকের প্রথমদিকে ভারতের জলপাইগুঁড়ি জেলার আমবাড়ি-ফালাকাটায় করতোয়া নদীর ওপর একটি ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়। এরমধ্যে ওই ব্যারাজটি তিস্তার ওপর স্থাপিত গজলডোবা ব্যারাজের আওতায় আনা হয়েছে। তিস্তা-মহানন্দা সংযোগ খালের আওতায় একটি ফিডার ক্যানেল মারফত করতোয়ার ৪২৫ কিউসেক পানি অন্যান্য ব্যারাজে নিয়ে যাওয়া হয়।
টাংগন
রানিসঙ্কৈলের জমিদারের নামে এই অভিন্ন নদী টাংগন ভারতের দার্জিলিং জেলা থেকে পঞ্চগড়ের অটোয়ারি উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অটোয়ারি, ঠাকুরগাঁও, পীরগঞ্জ ও বোচাগঞ্জ উপজেলা হয়ে ১৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পুনরায় দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ দিয়ে ভারতে গেছে নদীটি। এর অববাহিকা ৬০০ বর্গকিলোমিটার।
টাংগন নদীর উপর ৩৫’-৩৬ মীটার ব্যারাজ ৫টা রেডিয়াল গেট দিয়ে তৈরী করা হয় ২৫’৭ কিউবীক মিটার পানি/সেকেন্ড, নিরগমন ক্ষমতা সম্পন্ন ৪,৪৫০ হেক্টর ঠাকুরগাও সদরের কৃশি জমিতে পানি সেচের জন্য। ব্যারাজ এবং সেচের নালা তৈরিতে মোট খরচ হয় ১২৫ মিলিয়ন টাকা।
তালমা
সীমান্ত নদী তালমা ভারতের জলপাইগুঁড়ি থেকে পঞ্চগড় সদর উপজেলায় বাংলাদেশে প্রবেশ করে করতোয়ায় পড়েছে। মাত্র ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘের এই নদীটিতে বর্ষায় গভীরতা হয় মাত্র ৩.৫০ মিটার। ডাহুক নদী ভারতের জলপাইগুঁড়ি থেকে তেতুলিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পুনরায় ভারতের দার্জিলিং জেলায় চলে গেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১২ কিলোমিটার। পঞ্চগড়-বাংলাবান্দা সড়কে দুটি নদীর ব্রিজের নিচে ফসল চাষ হচ্ছে। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে নদীতে কোনো পানিই থাকছে না।
ঘোড়ামারা
ঘোড়ামারা ছোট্ট একটি সীমান্ত নদী। দৈর্ঘ্য মাত্র ১৩ কিলোমিটার। ভারতের জলপাইগুঁড়ি জেলা থেকে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলা দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে করতোয়ায় মিশেছে। এর অববাহিকা ৬৫ বর্গকিলোমিটার। স্লুইসগেট করে পানি সরিয়ে নেয়ায় শুকনো মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে যায়।
কুলিক
সীমান্ত নদী কুলিক ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর রায়পাড়া বিল থেকে উত্পন্ন হয়ে রানীসংকৈল উপজেলার ভিতর দিয়ে হরিপুরে নাগর নদীতে মিশেছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটার, প্রস্থ মাত্র ১০০ মিটার। একে আসলে নদী না বলে খাল বলাই শ্রেয়।
পঞ্চগড়ে ৮টি সীমান্ত নদীসহ মোট ২৫টি নদী। সীমান্ত নদীগুলোতে বাঁধ থাকার ফলে শুকনো মৌসুমে ভাটিতে পানির প্রবাহ কোন ক্ষেত্রে একেবারেই থাকছেনা আবার কখনো তা একেবারেই প্রয়োজনিয় সেচ কাজের জন্য অপ্রতুল। আবার বর্ষা আসতেই অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার ফলে ভেসে যায় ফসল কিংবা ঘর বাড়ী। উজানে বাধার কারণে প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের ৩৬টি নদীর কোনোটিতেই শুকনো মৌসুমে পানি থাকে না। আর বর্ষা আসতেই উজানের পানি ছেড়ে দেয়ায় পাহাড়ি ঢলে পুরো এলাকা তলিয়ে যায়।
ঢেপা
ছোট্ট এই নদীটির উতপত্তি হয়েছে আত্রাই থেকে মোহনপুরের কাছে এবং পড়েছে গিয়ে পুনরভবায়। এর দৈরঘ ৪০ কিলো মিটার।
উৎস – বিভিন্ন ওয়েবসাইট দিনাজপুরের উপর।
মন্তব্য
এসব ছোট এবং মাঝারি নদী নালা ছাড়াও বৃহত্তর দিনাজপুরে বিভিন্ন যায়গায় রয়েছে অনেক বিল, পুকুর এবং জলাশয়। যেসব জলাশয়ে পানি ধারন ক্ষমতা এবং এসবে সারা বছর যে পরিমান পানি শুকনো মওশুমেও এখন পর্যুন্ত মজুত থাকছে তা এসব জলাশয়ের আশেপাশের এলাকায় ভুগরভস্ত পানির স্তর যেমন স্বাভাবিক রাখছে তেমনি আনুপাতিক ভাবে পরিবেশ, জীব বৈচিত্র, জলবায়ু পরিবরত্তন এর প্রচন্ড আক্রোশ থেকে কিছুটা হলেও আমাদেরকে রক্ষা করছে। কাজেই নদী হউক বা এইসব ছোট বড় জলাধার হোক এসবে আরো নাব্যতা বা আরো বেশি পরিমান পানি যদি সারা বছর আটকিয়ে রাখা যায়, বর্তমান বৈরী আবহাওয়াকে তাহলে আমরা পুরোপুরি আনুকুল্যে নিতে না পারলেও আরও বৈরীতা থেকে হয়ত সামাল দিতে পারব।
রাম সাগর, আনন্দ সাগর, মাতা সাগর, সুখ সাগর, সামান্য প্রচেষ্টায় এসবে পানি ধারন ক্ষমতা আরও অনেক বাড়াতে পারা যাবে। যার মানে দাঁড়াবে, চাপকলে পানি আসবে, আবহাওয়ার রুক্ষতা কমবে, ফসলের আবাদ বাড়বে, সবুজ বাগান বা বনায়ন সহজ হবে, এরকম আরো অনেক সুবিধা সবাই ভোগ করতে পারবে। এজন্য যেটা দরকার সেটা হোল আপনার আর আমার মধ্যে এই সব জলাধারের নাব্যতা জিয়িয়ে রাখার সচেতনতা জাগাতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে।
এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য আমাদের পানি সম্পদ সন্বন্ধে ধারনা দেয়া। পুরা বিষয়টা ব্যাপক, সহজেই তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ দুরুহ, আপনি চাইলে আপনার বাড়ির পাশের জলাধার বা যা আপনি এই বিষয়ে জানেন সবাইকে তা জানানোর জন্য এই প্রতিবেদনটায় সংযোজন, পরিবর্ধন করতে পারেন। যা পারেন লিখে পাঠান এই ই-মেইল এ – mhaque18@ gmail.com .বাংলা অথবা ইংরেজিতে, আপনার নাম সহ এই প্রতিবেদনে যোগ করা হবে। উতস জানাতে ভুলবেন না। Admin -gdinajpurbd.com
মহানন্দা (পঞ্চগড়) থেকে জমুনেশ্যরি(ঘোড়াঘাট), ছোট মাঝারি এইসব নদীর এবং অসংখ্য জলাধার আমাদের প্রকৃতিকে রক্ষা করছে, আগলে রাখছে আমাদের জীবিকার উতস এবং উপায় গুলোকে। কিন্তু এসবের অস্তিত্ত রক্ষায় জানা দরকার এসবের বরতমান হাল………