দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়ক লাগোয়া পশ্চিমের স্থান নির্দেশক সাইনবোর্ড দেখে নেমে গেলাম বাঁয়ের পথে। এই পথে দুকিলোমিটারেরও কম দূরত্বে কান্তজী মন্দির। এই মন্দিরের প্রায় ২ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত নয়াবাদ মসজিদের দিকে যাত্রা করলাম। যদিও রাস্তার পুরোটা পাকা নয়, তবু পৌঁছে গেলাম বেশ সহজেই। নয়াবাদ গ্রামে অবস্থিত বলে মসজিদটি নয়াবাদ মসজিদ নামে খ্যাত। দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলায় এর অবস্থান। জেলা শহর দিনাজপুর এখান থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার উত্তর দিকে। মসজিদটির কেন্দ্রীয় প্রবেশপথের ওপরে দেয়ালে সাঁটা আছে একটি শিলালেখ। এই শিলালেখের বিবরণানুযায়ী মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় শাহ্ আলমের আমলে ১২০০ হিজরিতে এটি শেখ মুজিব আল্লাহ্র কর্তৃক নির্মিত হয়। সে সময় দিনাজপুরের শেষ মহারাজা বৈদ্যনাথ ছিলেন এ এলাকার জমিদার। মুঘল রীতির তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটি সম্পর্কে বেশ কিছু গল্পগাথা শুনলাম। যেমন দিনাজপুরের মহারাজা রামনাথের তত্ত¡াবধানে ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে এটি নির্মিত হয়। আবার বলা হচ্ছে দিল্লির সম্রাট আকবরের আমলে এটি নির্মিত হয়েছিল। মসজিদ চত্বরেই ঢেপিকুড়া নিবাসী ৩০ বছর বয়স্ক হাফেজ মোঃ মাহবুবুর রহমান বললেন, ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির বাদশাহ আকবরের আমলে এই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। এই মত যে যথাযথ নয় তা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মসজিদের সামনের দেয়ালে অনেক টেরাকোটার ফলকচিত্র সাঁটা আছে। তার মধ্যে সাধারণ চিত্র হলো ফুলের। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলো, ময়ূর এবং শেয়ালের মতো প্রাণীমূর্তি উৎকীর্ণ ফলক চিত্র এখানে পাওয়া গেছে! এই বিবরণ প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর প্রকাশিত Archaeological Survey Report of Greater Dinajpur District -এর (১৯৯৫ খ্রি.) ৩০ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত হয়েছে।
মসজিদের ওপরে আছে তিনটি সমান আকারের গম্বুজ। কলমি ফুল নকশায় গম্বুজ শীর্ষের সমাপ্তি ঘটেছে। চার কোনায় আছে ৪টি আট কোনাকার মিনার। প্রতি মিনারের গায়ে আছে পর্যায়ক্রমিক স্ফীতকায় অংশ। প্রতিটি মিনার শীর্ষে আছে ফাঁপা ও ক্ষুদ্রাক্ষর কক্ষ। প্রবেশপথ ও জানালাগুলো খিলানাকৃতির পত্রাকার ও খাঁজকাটা। পূর্ব দেয়ালে আছে ৩টি প্রবেশপথ এবং পশ্চিম দেয়ালে ভেতরের দিকে আছে ৩টি অবতল খিলানাকৃতির মেহরাব। মেহরাবগুলোতে টেরাকোটার ফলকচিত্রের কাজ আছে, যা বেশ ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যকে তুলে ধরছে। মসজিদের অভ্যন্তরভাগ ৩টি ভাগে বিভক্ত। দুটি খিলান এটিকে ৩ ভাগে ভাগ করেছে। ভেতরের দিক থেকে ছাদের সৌন্দর্য তৃপ্তিদায়ক। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে একটি করে জানালা আছে। প্রতিদিকে জানালার প্রতিপাশে একটি করে কুলুঙ্গি আছে। পশ্চিম দেয়ালে বড় মেহরাবের দুই ধারে ২টি কুলুঙ্গি আছে। প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ভ‚মি থেকে প্রায় ৯১.৫ সে.মি. উঁচু একটা ভিত্তিভ‚মি বা প্লাটফরমের পশ্চিম দিকে মসজিদটি অবস্থিত। ভেতরের দিক থেকে মূল মসজিদটির দৈর্ঘ্য ১২.৯ মিটার ও প্রস্থ ৪.৩০ মিটার।
মসজিদের সামনের চত্বরের পূর্বভাগে এক গম্বুজবিশিষ্ট একটি প্রবেশ তোরণ ছিল বলে মসজিদে অবস্থানকারী হাফেজ মোঃ মাহবুবুর রহমানের কাছে জানা গেল। তবে সে সবের অস্তিত্ব এখন নেই। তার কাছেই জানা গেল মসজিদ ভ‚মির মোট আয়তন ৫২ শতক। মসজিদের দেয়ালের গড় পুরুত্ব ১.১০ মিটার।
মসজিদের পূর্বভাগের চত্বরটি ১ মিটার উঁচু ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পূর্ব দেয়ালের মধ্যভাগে হাল আমলের প্রবেশ তোরণ আছে। এই দেয়াল এবং পাকা চত্বরের বিবরণ প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে আছে। তবে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, এই দুটো জিনিসের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তী সংস্কার কাজে তা অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে বানানো হয়েছে। অবশ্য এই মত যথার্থ বলে মনে হয়নি। কারণ মূল মসজিদটির স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করলে বোঝা যায় যে, তা একটি পাকা চত্বরের ওপর নির্মিত হয়েছিল। কাজেই প্রলম্বিত পূর্বভাগের চত্বরটিও সে সময়েই পাকা করে নির্মিত হয়েছিল। পরে ধ্বংস হয়ে গেলে প্রত্নত্তত্ত অধিদপ্তর কর্তৃক সংস্কারকালে তা পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে বলে মনে হয়। আর মুঘল যুগের অন্য কিছু মসজিদের পূর্বভাগের পাকা চত্বর এবং প্রবেশ তোরণের কথাও স্মরণযোগ্য। যশোরের কেশবপুর উপজেলার শেখপুরা গ্রামের তিন গম্বুজবিশিষ্ট মুঘল আমলের মসজিদ এবং কুষ্টিয়ার ঝাউদিয়া মসজিদের পূর্বভাগেও এমন পাকা চত্বর দেখেছি।
মসজিদের উত্তর পাশে একটি পাকা দালানের পশ্চিম দেয়ালের ভগ্নাবশেষ কোনো রকমে টিকে আছে। এটি বর্তমানে স্থানীয়দের কাছে হুজুরাখানার ধ্বংসাবশেষ হিসেবে খ্যাত। এই ধ্বংসাবশেষটি মূল মসজিদের সোজা উত্তরে। আর মসজিদের পূর্বদিকের পাকা চত্বর লাগোয়া দক্ষিণে চুন-সুরকির সাহায্যে ইটে বাঁধানো একাধিক কবর রয়েছে।
এসব কবরে শায়িত ব্যক্তিদের পরিচয় জানা যায় না। পুরো মসজিদ কাঠামোই চুন-সুরকির গাঁথুনিতে নির্মিত। মসজিদটির বাইরের দিকের যে দেয়ালগুলোতে পোড়ামাটির ফলকচিত্র নেই, সেদিকগুলোয়ও দেয়ালের কারুকাজ দেখার মতো। আরো একটি কথা, এই মসজিদটি প্রমাণ করে যে, শেষ মুঘল যুগে জনপদ হিসেবে স্থানটির গুরুত্ব ছিল। মসজিদটির সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভালো বলেই মনে হলো। তাই খুশি মনেই রওনা দিলাম উপজেলা সদর কাহারোলের দিকে।
https://www.shaptahik-2000.com/?p=1050