DinajpurBD

তালমা তীরের দুর্গনগরী

Posted April 21st, 2012 by |

তালমা তীরের দুর্গনগরী

খন্দকার মাহমুদুল হাসান

সাপ্তাহিক ২০০০  

পঞ্চগড় শহর ছাড়িয়ে পা রাখলাম উত্তরের পথে। গন্তব্য ভিতরগড়। দুপাশে সবুজের সমারোহ। সরু রাস্তা। গাড়িঘোড়ার চলাচল কম। জনকোলাহল তো নেই বললেই চলে। উত্তর-পূর্ব দিকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার নির্জন পথ অতিক্রম করে ঢুকে গেলাম ভিতরগড়ের সীমানায়। ডানে ঘুমিয়ে আছে ভিতরগড়ের দুর্গনগরী, আর বাঁয়ে বয়ে চলেছে শান্ত নদী তালমা। তবে গিয়েই বুঝলাম, এই বিশাল প্রত্নস্থলের সংরক্ষণ ব্যবস্থা কত নাজুক। গ্রামের পর গ্রাম গড়ে উঠেছে। চাষাবাদ দালানবাড়ি নির্মাণ, কূপ খনন প্রভৃতি চলছে ইচ্ছেমতো। মকর্দম ডাঙা, মাঘই মাছপুকুরি, মডেলহাট প্রভৃতি এলাকা ঘুরে নিজ চোখেই দেখলাম এসব। তবে আশার কথা, সবকিছুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। প্রায় মজে যাওয়া এবং জলে টলমল দীর্ঘ পরিখা, একের পর এক দুর্গপ্রাচীর এবং কয়েকটি প্রত্ন-ঢিবি টিকে আছে এখনো।

ভিতরগড় এদেশের সবচেয়ে বড় দুর্গনগরী। প্রাচীন মহানগরীগুলোর মধ্যেও আয়তনের দিক দিয়ে এটিই সব চেয়ে বড়। অনুমান করা হয়, এখানে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের দিকে একটি বড় বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। দুর্গনগরীটির অবস্থান ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে অমরখানা ইউনিয়নে। প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন (১৯৯৫, পৃ. ১১০) অনুযায়ী এখানে প্রাপ্ত পাথরের মূর্তির মধ্যে আছে ব্ল্যাক ব্যাসল্টে তৈরি মনসা, হনুমান, রামচন্দ্র প্রভৃতি মূর্তি। প্রত্যক্ষদর্শী আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়ার কাছ থেকে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে জানা গেছে যে, ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ভিতরগড় দিঘির দক্ষিণঘাটে একটি ভাঙা মূর্তি পড়ে ছিল, যা কাপড় ধোয়ার কাজে ব্যবহার হতো। তিনি এই মূর্তিটিকে খ্রিস্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতকের বলে অনুমান করেছেন। তবে সেই মূর্তি বা অন্য কোনো পাথরের সামগ্রী দেখার অনেক চেষ্টা করেও সফল হইনি। অবশ্য এখান থেকে মূর্তি ও পাথরের সামগ্রী পাওয়ার কথা স্থানীয়দের অনেকেই জানালেন। তবে সঙ্গে সঙ্গে তারা এও জানালেন যে, সেসবের কিছুই এখন আর দেখা যায় না।

‘কোচবিহারের ইতিহাস’ শীর্ষক গ্রন্থে (পৃ. ১০) খান চৌধুরী আমানত উল্লাহ আহমদ জনশ্রæতির ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন যে, খ্রিস্টীয় প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে কামরূপের শূদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত রাজা পৃথুর রাজধানী ছিল জলপাইগুড়ির দক্ষিণের ‘ভিতরগড়’-এ। এই বর্ণনার উল্লেখসহ আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া উল্লেখ করেন (বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ, ২০০৭, পৃ. ৫১), জনশ্রুতি অনুযায়ী ‘প্রায় খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে পৃথু নামক এক নৃপতি এই দুর্গনগরী নির্মাণ ও এ দিঘি খনন করেছিলেন। এই জনশ্রুতি মতে, সেই নৃপতি অতিশয় নীচু জাতীয় কোনো অসভ্য শত্রুদ্বারা পরাজিত হয়েছিলেন এবং নিজের সম্মান রক্ষার জন্য রাজা তার পরিবারের সমুদয় সদস্য ও সমগ্র ধনসম্পত্তি নিয়ে দিঘির জলে আত্মহত্যা করেছিলেন।’

২০০৯ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি থেকে ড. শাহনাজ হুসনে জাহানের নেতৃত্বে এখানে খননকাজ চলার পর মৃৎপাত্রসহ কিছু প্রত্নসামগ্রী এবং প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এখানকার প্রত্নস্থাপনাকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগেকার বলে তখন থেকে অনুমান করা হচ্ছে (ভিতরগড়ের ভেতরের কথা, মোঃ সাইফুল্লাহ, ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ২৫ জুন, ২০১১, পৃ. ৭) রাজবাড়ি ঢিবি ও কাচারি ঢিবি ঘুরে দেখার সময় রাজবাড়ি ঢিবি ও নিকটবর্তী কবরস্থানের নিচে খননকাজের স্থান দেখার সুযোগ হলো। এখানে কাদার গাঁথুনি দেয়া ইটের তৈরি পুরু প্রাচীর ১৬টি স্তম্ভ, বৌদ্ধ ধর্মীয় স্মৃতিসৌধ, মন্দির প্রভৃতি পাওয়ার সংবাদ পত্রিকায় পড়েছিলাম। একই সূত্রে এখানকার স্থাপনাকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের বলে উল্লেখ করা হয়েছিল (দুর্গনগরী রাজাবাড়ি, দৈনিক মানবজমিন, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। এই দুর্গনগরীর দৈর্ঘ্য ছিল উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার। (আলোকচিত্রে ইতিহাস বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর, এরিয়া সদর দপ্তর, রংপুর, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, ২০০৮, পৃ. ১৩৬ এবং বাঙলাদেশের প্রতœসম্পদ, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, ২০০৭, পৃ. ৪৬)। বোঝাই যায়, এটি বর্গাকার নয়। তবে এটি এমন আয়তাকার নয়, যার বিপরীত বাহুগুলো সমান। বরং এটি ট্রাপিজিয়ম আকৃতির। এর কোনো দুটো বাহুই হুবাহু সমান নয়।

এটিকে জটিল নকশার একটি বিচিত্র দুর্গ বলা যায়। আবার বলা যায়, এখানে পাশাপাশি তিনটি দুর্গের সহাবস্থান ছিল। এ কারণেই ডক্টর ফ্রান্সিস বুকানন ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গের যে নকশা করেছিলেন তাতে তিন স্তরের দুর্গ প্রাচীরের ভিত্তিতে একেবারে কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে ‘ইনার সিটি’ এবং এই ‘ইনার সিটি’কে ঘিরে রাখা দেয়ালের বাইরের অংশের নাম দিয়েছিলেন ‘মিডল সিটি’। মিডিল সিটিকে ঘিরে রাখা প্রাচীরের বাইরের অংশকে তিনি ‘আউটার সিটি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। ওই আউটার সিটিকেও ঘিরে রেখেছিল দুর্গ প্রাচীর।

ইনার সিটি বা কেন্দ্রীয় দুর্গের লাগোয়া পূর্বদিকে উত্তর দক্ষিণে লম্বা একটি বিশাল দিঘি আছে। দিঘিটির দৈর্ঘ্য ৫৯০ দশমিক ৯০ মিটার ও প্রস্থ ৩৬ দশমিক ৬৩ মিটার। বুকাননের মানচিত্রে দেখা যায়, দুর্গ প্রাচীর ভেদ করে উত্তর দিক দিয়ে দুর্গনগরীর ভেতরে ঢুকে গেছে তালমা নদী। আউটার সিটির দুর্গপ্রাচীর ভেদ করে তা মিডল সিটিতে ঢুকে এর দুর্গপ্রাচীরকে স্পর্শ করেছে। এরপর বেঁকে পশ্চিমে গিয়ে দুর্গপ্রাচীরের প্রায় সমান্তরালে তা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে।

ম্যাপ : মন্টোগোমারি মার্টিন-এর ‘ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার পঞ্চম খণ্ডের (১৯৭৬ সংস্করণ), ৪৪৩ পৃষ্ঠার ম্যাপ অবলম্বনে

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত মন্টোগোমারি মার্টিনের The History Antiquities Topography and Statistics of Eastern India গ্রন্থের পঞ্চম খণ্ডের (Rangpur and Assam, Indian Edition 1976) ৪৪৪-৪৪৬ পৃষ্ঠায় এই বিবরণের উল্লেখ আছে। তিনি ইনার সিটিতে পৃথু রাজার আবাসস্থল, বড় দিঘি ও এই সিটির প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় ছোট জলাশয় থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। তার বিবরণের খানিকটা অংশের অনুবাদ এ রকম, ‘…নগরীটি করতোয়ার কিছুটা পূর্বে অবস্থিত এবং তালমা নামের একটি ছোট নদী এটির ভেতর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়েছে। …নগরীটি চারটি এককেন্দ্রিক বেষ্টনীতে ঘেরা। সবচেয়ে ভেতরে রাজবাড়ি ছিল বলে কথিত এবং সার্বিক অবস্থা এই অনুমানের সত্যতা প্রতিপন্ন করে। এটি একটি সামন্তরিক যা উত্তর-দক্ষিণে ৬৯০ গজ এবং এর অর্ধেক পূর্ব-পশ্চিমে। …এই এলাকার মধ্যভাগে একটি ছোট পুকুর আছে, যার প্রতি পাড়ে আছে ইটের স্তূপ। দক্ষিণ-পূর্ব কোনায় অন্য একটি জলাশয় ও স্তূপ আছে। এই স্তূপগুলো সম্ভবত ব্যক্তিগত উপাসনার স্থান ছিল। …প্রাসাদের নিকটবর্তী দিঘিটি একটি উল্লেখযোগ্য কর্ম এবং এর পাড়ের উচ্চতা ও প্রশস্ততা দেখে বোঝা যায়, এটি অবশ্যই গভীর। উত্তর-দক্ষিণে এটি ৮০০ গজ লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে ৭০০ গজ। এটির উত্তর ও দক্ষিণ দিকে দুটি এবং পূর্ব ও পশ্চিম দিকে ইটে বাঁধানো তিনটি ঘাট ছিল। …প্রাসাদ ও বিশাল দিঘিকে ঘিরে রাখা ইনার সিটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৯৩০ গজ ও উত্তর-দক্ষিণে ৩৪৫ গজ দীর্ঘ। উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম দিকে যাওয়ার সময় আনুষঙ্গিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া ইটের তৈরি দুর্গপ্রাচীর ও একটি সংকীর্ণ পরিখা দেখেছিলাম। …মিডল সিটিটি পূর্ব-পশ্চিমে ৩৫৩০ গজ ও উত্তর-দক্ষিণে ৬৩৫০ গজ দীর্ঘ এবং একটি পরিখা ও মাটির দুর্গপ্রাচীরে ঘেরা। কিন্তু উত্তর দিকে যেখানে তালমা পরিখাতে ঢুকেছে এবং এর সঙ্গে একত্রে প্রবাহিত হয়েছে, সে স্থানটিকে মজবুত করার জন্য আরো একটি বাড়তি দেয়াল বানানো হয়েছিল। এটির পশ্চিম এলাকাটি ছিল পূর্বের চেয়ে বেশি চওড়া এবং দক্ষিণ ভাগটা উত্তরের মতো ততটা চওড়া নয়। এর দক্ষিণ প্রান্তের কাছে বাঘপুখোরি নামে একটি জলাশয় আছে, যেখানে রাজা কিছু বাঘ রাখতেন। উত্তর দিকে ইটের দুটো ছোট স্তূপ আছে, যেগুলোকে রাজার মন্ত্রীদের বাড়ি বলে অভিহিত করা হয় এবং এগুলোর আকৃতি দেখে এগুলোকে এ ধরনের মানুষের ব্যক্তিগত উপাসনার স্থান বলে মনে হয়। …আউটার সিটি একটি নিচু দেয়াল ও পরিখায় ঘেরা ছিল এবং সেখানে নীচু শ্রেণীর মানুষের বসবাস ছিল, যে কারণে তা হাঁড়ির গড় নামে পরিচিত। এটা মিডল সিটির পশ্চিম দেয়ালের ৩০০ গজ ও দক্ষিণ দেয়ালের ৫৭০ গজ দূরে। … আমার গাইডরা (পথপ্রদর্শকরা) বলেছিলেন যে, আউটার সিটির (বহিঃদুর্গ) মোট দৈর্ঘ্য উত্তর থেকে দক্ষিণে ছয় মাইল, যা সম্ভব বলে মনে হয়।’

পঞ্চাশ (১৯৫৮ খ্রি.) ও ষাটের (১৯৬৮ খ্রি.) দশকের পরিদর্শনের ভিত্তিতে আবুল কালাম মোহাম্মদ  যাকারিয়া (বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ, ২০০৭, পৃ. ৪৭) লিখেছেন, ‘ভেতরের অভ্যন্তরীণ দুর্গের পূর্বদিকের প্রাচীর ছাড়াও পূর্বদিকে ৩টি প্রাচীর ছিল এবং পশ্চিম দিকেও অনুরূপ ৩টি প্রাচীর ছিল। অভ্যন্তরীণ দুর্গের দক্ষিণ প্রাচীরে সর্বদক্ষিণ দিকে ছিল মোট ৭টি প্রাচীর। …স্থানীয়ভাবে নামাঙ্কিত তালমা নামের ছোট নদী (ব্রিটিশ আমলের শেষ মানচিত্রে খুব সম্ভব চাও নদী নামে অভিহিত) ভারতের জলপাইগুড়ি জেলা থেকে উৎপন্ন হয়ে দুর্গনগরীর বর্তমান উত্তর দিকের প্রাচীরের প্রায় মাঝামাঝি বীরবাঁধ নামক স্থানে দুর্গের ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং বর্তমানকালের দ্বিতীয় প্রাচীর ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে দক্ষিণ দিকের শেষ প্রাচীর ভেদ করে দক্ষিণ দিক দিয়ে পঞ্চগড় জেলা শহরের পূর্বে করতোয়া নদীতে গিয়ে পড়েছে। ভিতরগড় দুর্গের পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত আরো একটি ছোট নদী ছিল। ব্রিটিশ আমলের নকশায় তা দেখা যায়। সেই নদী বর্তমানে (১৯৮৮ খ্রি.) অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। তালমা ও সেই ক্ষুদ্র নদী ভিতরগড় দুর্গের পরিখাগুলোতে জল সরবরাহ করত। পূর্বদিকের দ্বিতীয় প্রাচীরের পূর্ব পাশে যে গভীর ও বারোমাস জলভরা ত্রিমোহিনী নামক পরিখা আজো (১৯৮৮ খ্রি.) দেখা যায় তা ওপরে উল্লিখিত পূর্ব দিকের সেই নদীটির অংশবিশেষ ছিল বলে ধারণা হয়। …প্রাচীরগুলোতে ফটক ছিল বলে মনে হয় এবং ফটকের স্থানগুলো ছিল খোলা। একটি তোরণ (খুব সম্ভব উত্তর দিকে দ্বিতীয়) যমদুয়ার এবং আর একটিকে (খুব সম্ভব উত্তরদিক থেকে চতুর্থ) কালদুয়ার বলা হতো।’

Archaeological Sarvey Report of Greater Dinajpur District (১৯৯৫ খ্রি.) এর শেষভাগে ড্রইং নং ৯তে ভিতরগড় দুর্গনগরীর যে চিত্র আছে তাতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ত্রিস্রোতা এবং পশ্চিম দিকে দুর্গের বহিঃপ্রাচীর সংলগ্ন একটি নদীর মরাখাতের চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে। মন্টোগোমারি মার্টিনের মানচিত্রে কালদুয়ারের অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছে। প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদনেও (১৯৯৫ খ্রি.) তালমা শালমারা ও তিস্তাভাঙা নদীগুলোর প্রবাহপথ ও কালদুয়ারের অবস্থানস্থল সম্পর্কের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। মন্টোগোমারি মার্টিন, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ও প্রত্নতত্ত অধিদপ্তরের প্রতিবেদন এই তিন বিবরণ বিশ্লেষণ করে এই দুর্গনগরীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, নদী, স্থানের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে সেগুলোর  সঙ্গে নিজে সরেজমিনে ঘুরে ঘুরে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলাম। নিজ চোখে দেখা অভিজ্ঞতা এবং উল্লিখিত বিবরণগুলো মিলিয়ে দুর্গনগরী ভিতরগড়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নদী-জলাশয়-ঢিবির একনজরে দেখার মতো তথ্য এখানে উল্লেখ করছি।

১.            তালমা নদী : তের জলপাইগুড়ি জেলা থেকে এসে ভিতরগড়ের উত্তর প্রাচীরের মাঝামাঝি ‘বীরবাঁধ’ নামের জায়গায় দুর্গের ভেতরে ঢুকেছে। তারপর পশ্চিমে এগিয়ে দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে এবং পঞ্চগড় শহরের পূর্বদিকে করতোয়ায় পড়েছে।

২.           শালমারা নদী : দুর্গ এলাকার অন্যতম নদী। পাথরঘাটা নামের স্থানে এটির মজে যাওয়া খাত দেখা যায়।

৩.           তিস্তা ভাঙা : দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে প্রবাহিত ছোট নদী।

৪.           মহারাজার দিঘি : ভিতরগড়ের অভ্যন্তরীণ দুর্গ বা ইনার সিটির ভেতরে অবস্থিত ৫৩ দশমিক ৭৯ একর আয়তনের বিশাল দিঘি। পাহাড়ের মতো উঁচু পাড়ের দেয়াল পাকা। দেয়ালের একাধিক জায়গায় ফাঁকা স্থান আছে। ৩৬৪ মি. লম্বা, ৩৭ মি. চওড়া এ দিঘির পাড় ৩ দশমিক ৬৫ মি. উঁচু। প্রাচীরের ইটের মাপ ১০ই. ´ ৮ ই. ´ ২ ই.। এ দিঘির সবদিকেই পাকা ঘাট ছিল এবং পাথরখণ্ড ও মূর্তিও পাওয়া গেছে এই দিঘি সংলগ্ন এলাকায়। দিঘিটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা।

৫.           মহারাজার ভিটা : মহারাজার দিঘির লাগোয়া পশ্চিমে মহারাজার বাড়ি অবস্থিত। এই বাড়িটির ৫৭ দশমিক ৯৫ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে মহারাজার ভিটা ঢিবি অবস্থিত। আশপাশের ভ‚মি থেকে এর উচ্চতা প্রায় ১ মি.। এটি ৪৩ দশমিক ৯৪ মিটার লম্বা ও ৩৯ দশমিক ৬৫ মিটার চওড়া। বর্তমানে এই ঢিবিতে বসতবাড়ি রয়েছে। আরো আছে বড় বড় গাছপালা। মৃৎপাত্র আর ইটের টুকরোর ছড়াছড়ি এ ঢিবিতে। তবে আস্ত ইটও প্রচুর দেখা গেল। নলক‚পের চত্বরে ঘিরে রাখা হয়েছে সে ইট। ইটের মাপ ২৫ সে. মি. ´ ২০.৩২ সে.মি. ´ ৫ দশমিক ০৮ সে.মি. থেকে শুরু করে সামান্য বড়। এই প্রতœঢিবিতে বাড়ি বানিয়ে বসবাসকারী মোজাম্মেল হক ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর তারিখে জানান, তিনি এই ঢিবিতে পরিচালিত প্রতœ উৎখননকালে এর মাটির নিচে আবিষ্কৃত মন্দির গৃহ দেখেছেন।

৬.           মহারাজার কাছারির বাড়ি : এটি একটি প্রত্নঢিবি। ইনার সিটি অর্থাৎ সবচেয়ে ভেতরের দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনার ৪৩ দশমিক ৭০ মিটার উত্তর-পশ্চিমে এই ঢিবির অবস্থান। এর আয়তন ১৫ বর্গমিটার, উচ্চতা ২ দশমিক ৭৫ মিটার। ইটের টুকরো ও খোলামকুচি এই ঢিবিতে পাওয়া যায়। দক্ষিণ পাড়ের পাকা কাঠামোসহ একটি ছোট পুকুর এই ঢিবির লাগোয়া উত্তরে আছে। ঢিবিটি নিঃসন্দেহে প্রতœস্থাপনাকে ধারণ করে আছে, যার রহস্য কিছুটা উন্মোচিত হয়েছে।

৭.           মহারাজার বাড়ি : মহারাজার দিঘির লাগোয়া পশ্চিমে প্রায় ১ মিটার উঁচু, উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ২২ মিটার লম্বা ও পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় ১৮ মিটার চওড়া প্রত্নঢিবির নাম মহারাজার বাড়ি। প্রাচীন মৃৎপাত্র ও ইটের খণ্ডাংশ এই ঢিবিতে যত্রতত্র পাওয়া যায়।

৮.           হাতিশুঁড় : একটি প্রতœঢিবি। বহিঃদক্ষিণ দুর্গপ্রাচীরের মধ্যভাগের কাছে এর অবস্থান। এখানে নির্মাণ কাঠামোর অস্তিত্ব রয়েছে।

৯.           কালদুয়ার : মন্টোগোমারি মার্টিনের গ্রন্থের ম্যাপে প্রদর্শিত প্রবেশ তোরণ।

১০.        যমদুয়ার : দুর্গের একটি প্রবেশ তোরণ।

১১.         মলানি দিঘি : ভিতরগড় দুর্গের ভেতরে মডেল হাটের নিকটে প্রায় ৬ একর জায়গাজুড়ে দিঘিটি অবস্থিত।

ভিতরগড় দুর্গনগরীর সবচেয়ে নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায় মহারাজার দিঘিতে গেলে। উঁচু পাড়ে ওঠার জন্য পাকা সিঁড়ি নির্মিত হয়েছে। সিঁড়িগুলো নতুন হলেও তার পাশেই বিশালাকৃতির চ্যাপ্টা ইটে তৈরি পাহাড়ের মতো উঁচু পাড়ের দেয়াল। বন-বনানীর ছায়ায় শীতল হাওয়ায় শান্ত দিঘির ¯^চ্ছ জলরাশি দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যায় সবারই। দিঘির ধারে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এর একটি পরিচিতি ফলক লাগানো হয়েছে। ওই ফলকের ঐতিহাসিক বিবরণ মুখ্যত জনশ্রুতিনির্ভর হলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও তা থেকে পাওয়া যায়। দুর্গ এলাকার ভেতরে ভারত সীমান্তের লাগোয়া দুর্গপ্রাচীরের গায়ে এবং প্রাচীর ঘেঁষে স্যালিলান টি এস্টেটের চা বাগান দেখলাম। নতুন বাগান পত্তনের কাজও চলছে।

চা বাগানের দৃশ্য নিঃসন্দেহে নয়নমনোহর, তবে তা প্রত্নস্থলের ভেতরে কেন করা হলো, এ প্রশ্নের জবাব জানা নেই এবং এ থেকেও প্রমাণ করে যে, এই অমূল্য প্রত্নস্থলটি রক্ষার ব্যাপারে যথাযথ নজর কখনই দেয়া হয়নি। ফেরার পথে এ কথাই মনে হতে লাগল বারবার।